Description
ভূমিকা
সঞ্চয়িতার কবিতাগুলি সংকলনের ভার আমি নিজে নিয়েছি। অন্যের উপরেই দিতাম। কেননা, কবিতা যে লেখে কবিতাগুলির অন্তরের ইতিহাস তার কাছে সুস্পষ্ট। বাহিরের প্রকাশে কবিতাগুলি উজ্জ্বল হয়েছে কি না হয়তো সেটা তার পক্ষে নিশ্চিত বোঝা কোনো কোনো স্কুলে সহজ হয় না।
কিন্তু, এই সংকলন উপলক্ষে একটি কথা বলবার সুযোগ পাব প্রত্যাশা করে এ কাজে হাত দিয়েছি। যাঁরা আমার কবিতা প্রকাশ করেন অনেক দিন থেকে তাঁদের সম্বন্ধে এই অনুভব করছি যে, আমার অল্প বয়সের যে-সকল রচনা স্খলিত পদে চলতে আরম্ভ করেছে মাত্র, যারা ঠিক কবিতার সীমার মধ্যে এসে পৌঁছয় নি, আমার গ্রন্থাবলীতে তাদের স্থান দেওয়া আমার প্রতি অবিচার।
মনে আছে কোনো-এক প্রবন্ধে আমার গানের সমালোচনায় এমন-সকল গানকে আমার কবিত্বের পঙ্গুতার দৃষ্টান্ত-স্বরূপে লেখক উদ্ধৃত করেছিলেন, যেগুলি ছাপার বইয়ে প্রশ্রয় পেয়ে আমাকে অনেক দিন থেকে লজ্জা দিয়ে এসেছে। সেগুলি অপরিণত মনের প্রকাশ অপরিণত ভাষায়। কেউ কেউ সেগুলিকে ভালোও বাসেন, সেই দুর্গতির জন্যে আমি দায়ী। প্রবন্ধলেখককে দোষ দিতে পারি নে, কেননা লেখায় যে অপরাধ করেছি ছাপার অক্ষরে তাকে সমর্থন করা হয়েছে।
যে কবিতাগুলিকে আমি নিজে স্বীকার করি তার দ্বারা আমাকে দায়ী করলে আমার কোনো নালিশ থাকে না। বন্ধুরা বলেন, ইতিহাসের ধারা রক্ষা করা চাই। আমি বলি, লেখা যখন কবিতা হয়ে উঠেছে তখন থেকেই তার ইতিহাস। এ নিয়ে অনেক তর্ক হতে পারে, সে কথা বলবার স্থান এনয়।
সন্ধ্যাসংগীত, প্রভাতসংগীত ও ছবি ও গান এখনো যে বই-আকারে চলছে, একে বলা যেতে পারে কালাতিক্রমণ-দোষ। বালক যদি প্রধানদের সভায় গিয়ে ছেলেমানুষি করে তবে সেটা সহ্য করা বালকদের পক্ষেও ভালো নয়, প্রধানদের পক্ষেও নয়। এও সেইরকম। ঐ তিনটি কবিতাগ্রন্থে আর কোনো অপরাধ নেই, কেবল একটি অপরাধ-লেখাগুলি কবিতার রূপ পায় নি। ডিমের মধ্যে
যে শাবক আছে সে যেমন পাখি হয়ে ওঠে নি-এটাতে কেউ দোষ দেবে না, কিন্তু তাকে পাখি বললে দোষ দিতেই হবে।
ইতিহাস-রক্ষার খাতিরে এই সংকলনে ঐ তিনটি বইয়ের যে-কয়টি লেখা সঞ্চয়িতায় প্রকাশ করা গেল তা ছাড়া ওদের থেকে আর-কোনো লেখাই আমি স্বীকার করতে পারব না। ভানুসিংহের পদাবলী সম্বন্ধেও সেই একই কথা। কড়ি ও কোমলে অনেক ত্যাজ্য জিনিস আছে, কিন্তু সেই পর্বে আমার কাব্য-ভূসংস্থানে ডাঙা জেগে উঠতে আরম্ভ করেছে।
তার পর মানসী থেকে আরম্ভ করে বাকি বইগুলির কবিতায় ভালো মন্দ মাঝারির ভেদ আছে, কিন্তু আমার আদর্শ অনুসারে ওরা প্রবেশিকা অতিক্রম করে কবিতার শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছে। এই গ্রন্থে যে কবিতাগুলি দিতে ইচ্ছা করেছি তার অনেকগুলিই দেওয়া হল না। স্থান নেই।
ছাপা অগ্রসর হতে হতে আয়তনের স্ফীতি দেখে ভীতমনে আত্মসংবরণ করেছি। এরকম সংকলন কখনোই সম্পূর্ণ হতে পারে না। মনের অবস্থা পরিবর্তন হয়, মনোযোগের তারতম্য ঘটে। অবিচার না হয়ে যায় না।
আমার লেখা যে-সকল কাব্যগ্রন্থ দীর্ঘকাল পাঠকদের পরিচিত, এই গ্রন্থে তাদেরই থেকে বিশেষ করে সংগ্রহ করা হয়েছে। যেগুলি অপেক্ষাকৃত অপরিচিত সেগুলি যথাস্থানে পূর্ণতর পরিচয়ের অপেক্ষায় রইল।
শান্তিনিকেতন পৌষ ১৩৩৮
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
Reviews
There are no reviews yet.